মনুর ১ । ১০৬ ৷ সম্পূর্ন শ্লোকটি হলো “ইদং স্বস্ত্যয়নং শ্রেষ্ঠমিদং বুদ্ধিবিবর্দ্ধনং। ইদং যশস্যমায়ুষ্যমিদং নিঃশ্রেয়সৎপরং” ॥ যার বাংলা অর্থ অনেকটা “এই শাস্ত্র অধ্যয়নই স্বস্ত্যয়ন অর্থাৎ অভীষ্ট সিদ্ধিদায়ক এবং শ্রেষ্ঠ এই শাস্ত্রাভ্যাসে বুদ্ধি বৃদ্ধি হওত আয়ুঃযশ এবং মোক্ষ লাভ হয়”।
উক্ত প্রতিজ্ঞ যুক্তি সিদ্ধ মনুষ্য মাত্রকে এবং পশ্বাদিকে ব্যবহার করিতে হইতেছে এবং যে ব্যবহার করতেছে ফল প্রাপ্ত অদ্যাপি হইতেছে এবং চিরকাল হইবেক, অত্র সন্দেহ মাত্র নাই ৷
আলোচনা প্রসঙ্গ থেকে পাওয়া যায়, ১৩৫৫ বাংলা সনের ৩২শে আষাঢ়, শুক্রবার, কথা পসঙ্গে উমাশঙ্কর চরন দা শ্রীশ্রীঠাকুরকে প্রশ্ন করেছিলেন, “স্বস্ত্যয়নী জিনিসটা কী? ইষ্টভৃতি তো আছে।“
প্রিয়পরম শ্রীশ্রীঠাকুর উত্তরে বলছেন, স্বস্ত্যয়নী একটা ব্রতবিশেষ। পাঁচটি নীতি নিয়ে স্বস্ত্যয়নী। এতে ক্রমোন্নতির অন্তরায়গুলি যেমন নিরুদ্ধ হয়, তেমনি উন্নতিলাভের পক্ষে অপরিহার্য্য গুণগুলি আয়ত্ত হয়, যাতে ক’রে সর্ব্ববিধ অমঙ্গল দূরীভূত হ’য়ে মঙ্গলের পথ প্রশস্ত হয়। তাছাড়া, এতে গ্রহবিপাক খণ্ডে। গ্রহ মানে that which makes one'S intellect obsessed ( যা' মানুষের বুদ্ধিকে অভিভুত করে)। যেমন শনিগ্রহ, রাহুগ্রহ। কর্ম্মফলে গ্রহ কুপিত হলে যে-সব শান্তি- স্বস্ত্যয়ন করে, তার থেকে ঢের ফল হয় স্বস্ত্যয়নী নীতিগুলি নিখুঁতভাবে পালন করায়। এ ব্রতের মূল কথা হ’লো যুগপৎ এই পাঁচটি নীতি পালন করতে হবেঃ-
(১) শরীরকে ইষ্টপুজার যন্ত্র বিবেচনা ক’রে সুস্থ ও সহনপটু ক’রে তুলতে হবে।
(২) মনের কোণে যখনই যে-কোন প্রবৃত্তি উকি মারুক না কেনো, তাকে ইষ্টস্বার্থ ও ইষ্টপ্রতিষ্ঠার অনুকূলে নিয়ন্ত্রিত করতে হবে।
(৩) যে- কাজে যখনই যা' ভাল ব’লে মনে হবে, তা' কাজে ফুটিয়ে তুলতে হবে।
(৪) পারিপার্শ্বিকের বাঁচা-বাড়াকে নিজেরই বাঁচা-বাড়ার স্বার্থজ্ঞানে তাদের যাজনসেবায় ইষ্টে আকৃষ্ট ও যুক্ত ক’রে উন্নত-চলৎশীল করে তুলতে হবে।
(৫) আর, চাই নিজের কর্ম্মশক্তি, উদ্ভাবনীবুদ্ধি ও অর্জ্জনপটুতাকে বাড়িয়ে তুলে নিত্য বিধিমাফিক অর্ঘ্য-নিবেদন। এই সবগুলি আচরণ করলে তবেই স্বস্ত্যয়নী পালন করা হলো।
সূর্য্যের যেমন রোজই সংক্রমণ হচ্ছে। একটা range (এলাকা) থেকে যখন অন্য range-এ ( এলাকায়) যায়, তখন তাকে বলে সংক্রন্তি। স্বস্ত্যয়নী ব্রত নিষ্ঠাসহকারে প্রতিটি নীতিবিধিসহ পালন করতে থাকলে আমাদেরও তেমনি সূর্য্যের সাথে-সাথে নিত্য সেই ব্রতনুযায়ী জীবন-চলনার ক্ষেত্রে ধীরে-ধীরে এক নতুন জগতে সংক্রমণ অর্থাৎ অনুপ্রবেশ সংঘটিত হ’তে থাকে। এই ইষ্টাভিমুখী সংক্রমণের ফলে প্রবৃত্তি-অভিভূতির নাগপাশ থেকে আমরা ধীরে ধীরে মুক্তিলাভ করতে পারি, তখন গ্রহ বা গেরো বা complex -এর (প্রবৃত্তির) knot (গ্রন্থি) আমাদের কাবেজ করতে পারে কমই।
স্বস্ত্যয়নী যেহেতু একটা ব্রতবিশেষ। পাঁচটি নীতি নিয়েই শ্রীশ্রীঠাকুর প্রবর্তিত এই স্বস্ত্যয়নী। আলোচনা প্রসঙ্গে থেকে বুঝতে পারি এই ব্রত পালন করলে ক্রমোন্নতির-অন্তরায়গুলি যেমন নিরুদ্ধ হয়, তেমনি উন্নতি লাভের পক্ষে অপরিহার্য্য গুণগুলি আয়ত্ত হয়, যাতে করে সৰ্ব্ববিধ অমঙ্গল দূরীভূত হয়ে মঙ্গলের পথ প্রশস্ত হয় মানুষের। তাছাড়া, এতে গ্রহবিপাকও খণ্ডে বা কেটে যায়। এখানে গ্রহ মানে যা মানুষের বুদ্ধিকে অভিভূত করে রাখে। আমাদের কর্ম্মফলের কারনে গ্রহ কুপিত হলে যে-সব শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করা হয়, তার থেকে ঢের বেশী ফল হয় স্বস্ত্যয়নীর নীতিগুলি নিখুঁত ভাবে পালন করায়। শ্রীশ্রীঠাকুর-এর সকল দীক্ষিতদের ‘ইষ্টভৃতি’ দীক্ষা নিলেই করতে হয় দীক্ষাকে চেতন রাখবার জন্য, জীয়ন্ত রাখবার জন্য। আমরা জানি যজন-যাজন-ইষ্টভৃতি অস্তিত্বকে ধরে রাখে কিন্তু আরোতর বর্দ্ধনার জন্য স্বস্ত্যয়নী ব্রত গ্রহণ ও পালন করে চলতেই হবে।
এই স্বস্ত্যয়নী কথাটা এসেছে ‘স্বস্ত্যয়ন’ কথা থেকে যার মানে – “সু+অস্তি+অয়ন”- অর্থাৎ প্রকৃষ্টভাবে বেঁচে থাকার পথ। মানব জীবনের চরম ও পরম সম্ভাব্যতাকে বাস্তবে ফুটিয়ে তোলাই হলো জীবনের সাধনা। তার জন্য আমাদের চাই দেহ, মন, ইচ্ছাশক্তি ও পারিপার্শ্বিকের ইষ্টানুকূল নিয়ন্ত্রণ, সামঞ্জস্য ও সমাধান ৷ তারই অপূর্ব্ব সঙ্কেত আছে স্বস্ত্যয়নীর পাঁচটি নীতির মধ্যে। স্বস্ত্যয়নী ব্রত পালন করা মানেই হলো ঐ পাঁচটি নীতিরই নিখুঁত অনুশীলন ও অনুসরণ করা।
সাধারণত অনেকেই মনেকরেন, স্বস্ত্যয়নী মানেই হচ্ছে নিরামিষ আহার, যারা স্বস্ত্যয়নী নেয়নি তাদের হাতে ভাত না খাওয়া, তিন টাকা ইষ্টার্ঘ্য হিসাবে পাঠিয়ে বাকি টাকা নিজের কাছে গচ্ছিত রাখা ইত্যাদি। আসলেই কি তাই? সনাতন ধর্মের মানুষ হাজার বছর ধরে তিন ধরনের খাবার গ্রহন করে আসছে, ক) সাত্ত্বিক আহার খ) রাজসিক আহার গ) তামসিক আহার। সংক্ষেপে এই বিষয়ে একটু বলি……
ক) সাত্ত্বিক খাবার হল, এমন সকল খাদ্য যা খাদ্যের উপর ভিত্তি করে তিনটি যোগিক গুণাবলীর মধ্যে গুণ ধারণ করে যা ‘সত্ত্ব’ নামে পরিচিত। প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় যুগের সাহিত্যে থেকে দেখা যায় ধারণাটি মিতাহার, যার আক্ষরিক অর্থ হলো “খাওয়ার মধ্যপন্থা”। তাছাড়া সাত্ত্বিক খাদ্য হল আয়ুর্বেদিক সাহিত্যে প্রস্তাবিত এক ধরনের চিকিৎসা। সাত্ত্বিক শব্দটি সত্ত্ব থেকে উদ্ভূত যা একটি সংস্কৃত শব্দ। সত্ত্ব হল ভারতীয় দর্শনের একটি জটিল ধারণা, যা অনেক প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়ছে এবং এর অর্থ হল "বিশুদ্ধ, সারাংশ, প্রকৃতি, অত্যাবশ্যক, শক্তি, পরিষ্কার, সচেতন, শক্তিশালী, সাহস, সত্য, সৎ, জ্ঞানী, জীবনের মৌলিকতা" ইত্যাদি। এইভাবে সাত্ত্বিক খাদ্যের অর্থ হল খাদ্য ও খাওয়ার অভ্যাসকে অন্তর্ভুক্ত করা যা "বিশুদ্ধ, অপরিহার্য, প্রাকৃতিক, অত্যাবশ্যক, শক্তি প্রদানকারী, পরিষ্কার, সচেতন, সত্য, সৎ, জ্ঞানী"।
খ) রাজসিক বা রাজস খাদ্যকে মশলাদার, গরম, ভাজা বা অম্লীয় খাবার হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়ে থাকে। এই ধরনের খাবার দুঃখ বা অসুস্থতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। জাঙ্ক ফুড বা সংরক্ষিত খাবারকে প্রায়ই রাজসিক হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে।
গ) তামসিক খাবার বা স্ট্যাটিক ফুডও বলা হয়, এমন খাবার যা যোগব্যায়াম অনুসারে খাওয়া মন ও শরীর উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। মনের ক্ষতির মধ্যে এমন কিছু অন্তর্ভুক্ত যা একটি নিস্তেজ, কম পরিমার্জিত চেতনার অবস্থার দিকে নিয়ে যেতে পারে। শারীরিক ক্ষতির মধ্যে এমন কোনো খাবার অন্তর্ভুক্ত যা কোনো শারীরিক অঙ্গের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিকর চাপ সৃষ্টি করবে।
এবার একটু জৈন নিরামিষবাদ জেনে নেই আমরা, জৈন সংস্কৃতি এবং দর্শনের অনুগামীরা অনুসরণ করে গঠিত। এটি হলো ভারতীয় উপমহাদেশ এবং তার বাইরে আধ্যাত্মিকভাবে অনুপ্রাণিত খাদ্যতালিকার সবচেয়ে কঠোর রূপগুলির মধ্যে একটি নীতি। জৈন ধর্মের রন্ধনপ্রণালী সম্পূর্ণরূপে ল্যাকটো বা নিরামিষ ভোজন। আমরা অনেকেই হয়তো যানি না, জৈনরা ছোট পোকামাকড় এবং অণুজীবের ক্ষতি আটকাতে এবং পুরো গাছটিকে উপড়ে ফেলাতে গাছটির মারা যাওয়ার সম্ভাবনাকে প্রতিরোধ করতেই তারা মূল এবং ভূগর্ভস্থ সবজি যেমন- আলু, রসুন, পেঁয়াজ ইত্যাদি খাবার খায় না।
এই নিয়ম জৈন তপস্বী এবং সাধারণ জৈনরা মেনে চলছে হাজার বছর ধরে। অহিংসা নীতির উপর ভিত্তি করেই সাধারনত মাংস, মাছ এবং ডিম খাওয়ার নিষেধগুলি তৈরি। জৈন-রা মনে করেন, প্রত্যেকটি কাজ যার দ্বারা কোন ব্যক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হত্যা বা আঘাতকে সমর্থন করে তাকে সহিংসতার কাজ হিসাবে দেখা হয় যা ক্ষতিকর কর্মফল সৃষ্টি করে থাকে। অহিংসার মূল উদ্দেশ্যই হল এই ধরনের কর্মের সঞ্চয় রোধ করা। হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এই সদিচ্ছার কার্যকরিতা ব্যাপকভাবে আলাদা মত রয়েছে।
নিয়ম অনুসারে লেখা শেষ করতে হবে, শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র লোক কল্যানে মনু সংহিতার উক্ত মন্ত্রকে নবীকরণ করতে প্রবর্তন করলে স্বস্ত্যয়নী ব্রতবিধির । যদিও স্বস্ত্যয়নীর প্রবর্তন করেছিলেন প্রথমে ১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দে আর ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দে ইষ্টভৃতি।
পঞ্চনীতি সমন্বিত এই স্বস্ত্যয়নী ব্রতের প্রবর্তন করেছিলেন শ্রীশ্রীঠাকুর, বাণী আকারে বলেছেন……
১. শ্রীবিগ্রহের মন্দির ভেবে
যত্ন করিস শরীরটাকে,
সহনপটু সুস্থ রাখিস
বিধি মাফিক পালিস তাকে;
২. প্রবৃত্তি তোর যখন যেমন
যেভাবেই উঁকি মারুক,
ইষ্টস্বার্থ প্রতিষ্ঠাতে ঘুরিয়ে দিবি
তা’র সে ঝোঁক;
৩. যে-কাজে যা’ ভাল ব’লে
আসবে মনে তৎক্ষনাৎ
হাতে-কলমে করবি রে তা’
রোধ করে তা’র সব ব্যাঘাত;
৪. পাড়াপড়শীর বাঁচা-বাড়ায়
রাখিস রে তুই স্বার্থটান,
তাদের ভালয় চেতিয়ে তুলিস
ইষ্টানুগ ক’রে প্রাণ;
৫. নিজের সেবার আগে রোজই
শক্তি মত যেমন পারিস,
ইষ্ট অর্ঘ্য ভক্তিভরে
শুচিতে নিবেদন করিস;
এই নিয়মে নিত্যদিন
প্রতি কাজেই সর্ব্বক্ষণ
স্বস্ত্যয়নীর নিয়মগুলি
পালিস দিয়ে অটুট মন;
ত্রিশটি দিন পুরে গেলে
মাসিক অর্ঘ্য সদক্ষিণায়
ইষ্টভোজ্য পাঠিয়ে বাকি
মজুত রাখবি বর্দ্ধনায়;
চিরজীবন এমনি ক’রে
ইষ্টস্থানে হয় নিরত,
তা’কেই বলে স্বস্ত্যয়নী
সবার সেরা মহান ব্রত।
~ জয়গুরু সকলকে ~