The Web This Blog

Wednesday, May 22, 2024

আর্য্য শাস্ত্র মনু সংহিতায় বর্ণিত “ইদং স্বস্ত্যয়নং” অর্থ কি?

মনুর ১ । ১০৬ ৷ সম্পূর্ন শ্লোকটি হলো “ইদং স্বস্ত্যয়নং শ্রেষ্ঠমিদং বুদ্ধিবিবর্দ্ধনং। ইদং যশস্যমায়ুষ্যমিদং নিঃশ্রেয়সৎপরং” ॥ যার বাংলা অর্থ অনেকটা “এই শাস্ত্র অধ্যয়নই স্বস্ত্যয়ন অর্থাৎ অভীষ্ট সিদ্ধিদায়ক এবং শ্রেষ্ঠ এই শাস্ত্রাভ্যাসে বুদ্ধি বৃদ্ধি হওত আয়ুঃযশ এবং মোক্ষ লাভ হয়”।

উক্ত প্রতিজ্ঞ যুক্তি সিদ্ধ মনুষ্য মাত্রকে এবং পশ্বাদিকে ব্যবহার করিতে হইতেছে এবং যে ব্যবহার করতেছে ফল প্রাপ্ত অদ্যাপি হইতেছে এবং চিরকাল হইবেক, অত্র সন্দেহ মাত্র নাই ৷

আলোচনা প্রসঙ্গ থেকে পাওয়া যায়, ১৩৫৫ বাংলা সনের ৩২শে আষাঢ়, শুক্রবার, কথা পসঙ্গে উমাশঙ্কর চরন দা শ্রীশ্রীঠাকুরকে প্রশ্ন করেছিলেন, “স্বস্ত্যয়নী জিনিসটা কী? ইষ্টভৃতি তো আছে।“

প্রিয়পরম শ্রীশ্রীঠাকুর উত্তরে বলছেন, স্বস্ত্যয়নী একটা ব্রতবিশেষ। পাঁচটি নীতি নিয়ে স্বস্ত্যয়নী। এতে ক্রমোন্নতির অন্তরায়গুলি যেমন নিরুদ্ধ হয়, তেমনি উন্নতিলাভের পক্ষে অপরিহার্য্য গুণগুলি আয়ত্ত হয়, যাতে ক’রে সর্ব্ববিধ অমঙ্গল দূরীভূত হ’য়ে মঙ্গলের পথ প্রশস্ত হয়। তাছাড়া, এতে গ্রহবিপাক খণ্ডে। গ্রহ মানে that which makes one'S intellect obsessed ( যা' মানুষের বুদ্ধিকে অভিভুত করে)। যেমন শনিগ্রহ, রাহুগ্রহ। কর্ম্মফলে গ্রহ কুপিত হলে যে-সব শান্তি- স্বস্ত্যয়ন করে, তার থেকে ঢের ফল হয় স্বস্ত্যয়নী নীতিগুলি নিখুঁতভাবে পালন করায়। এ ব্রতের মূল কথা হ’লো যুগপৎ এই পাঁচটি নীতি পালন করতে হবেঃ-

(১) শরীরকে ইষ্টপুজার যন্ত্র বিবেচনা ক’রে সুস্থ ও সহনপটু ক’রে তুলতে হবে।

(২) মনের কোণে যখনই যে-কোন প্রবৃত্তি উকি মারুক না কেনো, তাকে ইষ্টস্বার্থ ও ইষ্টপ্রতিষ্ঠার অনুকূলে নিয়ন্ত্রিত করতে হবে।

(৩) যে- কাজে যখনই যা' ভাল ব’লে মনে হবে, তা' কাজে ফুটিয়ে তুলতে হবে।

(৪) পারিপার্শ্বিকের বাঁচা-বাড়াকে নিজেরই বাঁচা-বাড়ার স্বার্থজ্ঞানে তাদের যাজনসেবায় ইষ্টে আকৃষ্ট ও যুক্ত ক’রে উন্নত-চলৎশীল করে তুলতে হবে।

(৫) আর, চাই নিজের কর্ম্মশক্তি, উদ্ভাবনীবুদ্ধি ও অর্জ্জনপটুতাকে বাড়িয়ে তুলে নিত্য বিধিমাফিক অর্ঘ্য-নিবেদন। এই সবগুলি আচরণ করলে তবেই স্বস্ত্যয়নী পালন করা হলো।

সূর্য্যের যেমন রোজই সংক্রমণ হচ্ছে। একটা range (এলাকা) থেকে যখন অন্য range-এ ( এলাকায়) যায়, তখন তাকে বলে সংক্রন্তি। স্বস্ত্যয়নী ব্রত নিষ্ঠাসহকারে প্রতিটি নীতিবিধিসহ পালন করতে থাকলে আমাদেরও তেমনি সূর্য্যের সাথে-সাথে নিত্য সেই ব্রতনুযায়ী জীবন-চলনার ক্ষেত্রে ধীরে-ধীরে এক নতুন জগতে সংক্রমণ অর্থাৎ অনুপ্রবেশ সংঘটিত হ’তে থাকে। এই ইষ্টাভিমুখী সংক্রমণের ফলে প্রবৃত্তি-অভিভূতির নাগপাশ থেকে আমরা ধীরে ধীরে মুক্তিলাভ করতে পারি, তখন গ্রহ বা গেরো বা complex -এর (প্রবৃত্তির) knot (গ্রন্থি) আমাদের কাবেজ করতে পারে কমই।

স্বস্ত্যয়নী যেহেতু একটা ব্রতবিশেষ। পাঁচটি নীতি নিয়েই শ্রীশ্রীঠাকুর প্রবর্তিত এই স্বস্ত্যয়নী। আলোচনা প্রসঙ্গে থেকে বুঝতে পারি এই ব্রত পালন করলে ক্রমোন্নতির-অন্তরায়গুলি যেমন নিরুদ্ধ হয়, তেমনি উন্নতি লাভের পক্ষে অপরিহার্য্য গুণগুলি আয়ত্ত হয়, যাতে করে সৰ্ব্ববিধ অমঙ্গল দূরীভূত হয়ে মঙ্গলের পথ প্রশস্ত হয় মানুষের। তাছাড়া, এতে গ্রহবিপাকও খণ্ডে বা কেটে যায়। এখানে গ্রহ মানে যা মানুষের বুদ্ধিকে অভিভূত করে রাখে। আমাদের কর্ম্মফলের কারনে গ্রহ কুপিত হলে যে-সব শান্তি-স্বস্ত্যয়ন করা হয়, তার থেকে ঢের বেশী ফল হয় স্বস্ত্যয়নীর  নীতিগুলি নিখুঁত ভাবে পালন করায়। শ্রীশ্রীঠাকুর-এর সকল দীক্ষিতদের ‘ইষ্টভৃতি’ দীক্ষা নিলেই করতে হয় দীক্ষাকে চেতন রাখবার জন্য, জীয়ন্ত রাখবার জন্য। আমরা জানি যজন-যাজন-ইষ্টভৃতি অস্তিত্বকে ধরে রাখে কিন্তু আরোতর বর্দ্ধনার জন্য স্বস্ত্যয়নী ব্রত গ্রহণ ও পালন করে চলতেই হবে।

এই স্বস্ত্যয়নী কথাটা এসেছে ‘স্বস্ত্যয়ন’ কথা থেকে যার মানে – “সু+অস্তি+অয়ন”- অর্থাৎ প্রকৃষ্টভাবে বেঁচে থাকার পথ। মানব জীবনের চরম ও পরম সম্ভাব্যতাকে বাস্তবে ফুটিয়ে তোলাই হলো জীবনের সাধনা। তার জন্য আমাদের চাই দেহ, মন, ইচ্ছাশক্তি ও পারিপার্শ্বিকের ইষ্টানুকূল নিয়ন্ত্রণ, সামঞ্জস্য ও সমাধান ৷ তারই অপূর্ব্ব সঙ্কেত আছে স্বস্ত্যয়নীর পাঁচটি নীতির মধ্যে। স্বস্ত্যয়নী ব্রত পালন করা মানেই হলো ঐ পাঁচটি নীতিরই নিখুঁত অনুশীলন ও অনুসরণ করা।

সাধারণত অনেকেই মনেকরেন, স্বস্ত্যয়নী মানেই হচ্ছে নিরামিষ আহার, যারা স্বস্ত্যয়নী নেয়নি তাদের হাতে ভাত না খাওয়া, তিন টাকা ইষ্টার্ঘ্য হিসাবে পাঠিয়ে বাকি টাকা নিজের কাছে গচ্ছিত রাখা ইত্যাদি। আসলেই কি তাই? সনাতন ধর্মের মানুষ হাজার বছর ধরে তিন ধরনের খাবার গ্রহন করে আসছে, ক) সাত্ত্বিক আহার খ) রাজসিক আহার গ) তামসিক আহার। সংক্ষেপে এই বিষয়ে একটু বলি……

ক) সাত্ত্বিক খাবার হল, এমন সকল খাদ্য যা খাদ্যের উপর ভিত্তি করে তিনটি যোগিক গুণাবলীর মধ্যে গুণ ধারণ করে যা ‘সত্ত্ব’ নামে পরিচিত। প্রাচীন এবং মধ্যযুগীয় যুগের সাহিত্যে থেকে দেখা যায় ধারণাটি মিতাহার, যার আক্ষরিক অর্থ হলো “খাওয়ার মধ্যপন্থা”। তাছাড়া সাত্ত্বিক খাদ্য হল আয়ুর্বেদিক সাহিত্যে প্রস্তাবিত এক ধরনের চিকিৎসা। সাত্ত্বিক শব্দটি সত্ত্ব থেকে উদ্ভূত যা একটি সংস্কৃত শব্দ। সত্ত্ব হল ভারতীয় দর্শনের একটি জটিল ধারণা, যা অনেক প্রসঙ্গে ব্যবহৃত হয়ছে এবং এর অর্থ হল "বিশুদ্ধ, সারাংশ, প্রকৃতি, অত্যাবশ্যক, শক্তি, পরিষ্কার, সচেতন, শক্তিশালী, সাহস, সত্য, সৎ, জ্ঞানী, জীবনের মৌলিকতা" ইত্যাদি। এইভাবে সাত্ত্বিক খাদ্যের অর্থ হল খাদ্য ও খাওয়ার অভ্যাসকে অন্তর্ভুক্ত করা যা "বিশুদ্ধ, অপরিহার্য, প্রাকৃতিক, অত্যাবশ্যক, শক্তি প্রদানকারী, পরিষ্কার, সচেতন, সত্য, সৎ, জ্ঞানী"।

খ) রাজসিক বা রাজস খাদ্যকে মশলাদার, গরম, ভাজা বা অম্লীয় খাবার হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়ে থাকে। এই ধরনের খাবার দুঃখ বা অসুস্থতার দিকে নিয়ে যেতে পারে। জাঙ্ক ফুড বা সংরক্ষিত খাবারকে প্রায়ই রাজসিক হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে। 

গ) তামসিক খাবার বা স্ট্যাটিক ফুডও বলা হয়, এমন খাবার যা যোগব্যায়াম অনুসারে খাওয়া মন ও শরীর উভয়ের জন্যই ক্ষতিকর। মনের ক্ষতির মধ্যে এমন কিছু অন্তর্ভুক্ত যা একটি নিস্তেজ, কম পরিমার্জিত চেতনার অবস্থার দিকে নিয়ে যেতে পারে। শারীরিক ক্ষতির মধ্যে এমন কোনো খাবার অন্তর্ভুক্ত যা কোনো শারীরিক অঙ্গের জন্য প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ক্ষতিকর চাপ সৃষ্টি করবে।

এবার একটু জৈন নিরামিষবাদ জেনে নেই আমরা, জৈন সংস্কৃতি এবং দর্শনের অনুগামীরা অনুসরণ করে গঠিত। এটি হলো ভারতীয় উপমহাদেশ এবং তার বাইরে আধ্যাত্মিকভাবে অনুপ্রাণিত খাদ্যতালিকার সবচেয়ে কঠোর রূপগুলির মধ্যে একটি নীতি। জৈন ধর্মের রন্ধনপ্রণালী সম্পূর্ণরূপে ল্যাকটো বা নিরামিষ ভোজন। আমরা অনেকেই হয়তো যানি না, জৈনরা ছোট পোকামাকড় এবং অণুজীবের ক্ষতি আটকাতে এবং পুরো গাছটিকে উপড়ে ফেলাতে গাছটির মারা যাওয়ার সম্ভাবনাকে প্রতিরোধ করতেই তারা মূল এবং ভূগর্ভস্থ সবজি যেমন- আলু, রসুন, পেঁয়াজ ইত্যাদি খাবার খায় না।

এই নিয়ম জৈন তপস্বী এবং সাধারণ জৈনরা মেনে চলছে হাজার বছর ধরে। অহিংসা নীতির উপর ভিত্তি করেই সাধারনত মাংস, মাছ এবং ডিম খাওয়ার নিষেধগুলি তৈরি। জৈন-রা মনে করেন, প্রত্যেকটি কাজ যার দ্বারা কোন ব্যক্তি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হত্যা বা আঘাতকে সমর্থন করে তাকে সহিংসতার কাজ হিসাবে দেখা হয় যা ক্ষতিকর কর্মফল সৃষ্টি করে থাকে। অহিংসার মূল উদ্দেশ্যই হল এই ধরনের কর্মের সঞ্চয় রোধ করা। হিন্দু, বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে এই সদিচ্ছার কার্যকরিতা ব্যাপকভাবে আলাদা মত রয়েছে।

নিয়ম অনুসারে লেখা শেষ করতে হবে, শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র লোক কল্যানে মনু সংহিতার উক্ত মন্ত্রকে নবীকরণ করতে প্রবর্তন করলে স্বস্ত্যয়নী ব্রতবিধির । যদিও স্বস্ত্যয়নীর প্রবর্তন করেছিলেন প্রথমে ১৯৩৭ খ্রীষ্টাব্দে আর ১৯৩৮ খ্রীষ্টাব্দে ইষ্টভৃতি।

পঞ্চনীতি সমন্বিত এই স্বস্ত্যয়নী ব্রতের প্রবর্তন করেছিলেন শ্রীশ্রীঠাকুর, বাণী আকারে বলেছেন……

১. শ্রীবিগ্রহের মন্দির ভেবে 
যত্ন করিস শরীরটাকে, 
সহনপটু সুস্থ রাখিস 
বিধি মাফিক পালিস তাকে;

২. প্রবৃত্তি তোর যখন যেমন
যেভাবেই উঁকি মারুক,
ইষ্টস্বার্থ প্রতিষ্ঠাতে ঘুরিয়ে দিবি
তা’র সে ঝোঁক;

৩. যে-কাজে যা’ ভাল ব’লে
আসবে মনে তৎক্ষনাৎ 
হাতে-কলমে করবি রে তা’ 
রোধ করে তা’র সব ব্যাঘাত;

৪. পাড়াপড়শীর বাঁচা-বাড়ায়
রাখিস রে তুই স্বার্থটান,
তাদের ভালয় চেতিয়ে তুলিস
ইষ্টানুগ ক’রে প্রাণ;

৫. নিজের সেবার আগে রোজই
শক্তি মত যেমন পারিস,
ইষ্ট অর্ঘ্য ভক্তিভরে
শুচিতে নিবেদন করিস;
এই নিয়মে নিত্যদিন
প্রতি কাজেই সর্ব্বক্ষণ
স্বস্ত্যয়নীর নিয়মগুলি
পালিস দিয়ে অটুট মন;
ত্রিশটি দিন পুরে গেলে
মাসিক অর্ঘ্য সদক্ষিণায়
ইষ্টভোজ্য পাঠিয়ে বাকি
মজুত রাখবি বর্দ্ধনায়;
চিরজীবন এমনি ক’রে
ইষ্টস্থানে হয় নিরত,
তা’কেই বলে স্বস্ত্যয়নী
সবার সেরা মহান ব্রত।

 ~ জয়গুরু সকলকে ~

Monday, May 20, 2024

কাহাকেও অন্যায়ের জন্য যদি তুমি শাস্তিবিধান কর, নিশ্চয়ই জেনো – পরমপিতা ঐ শাস্তি উভয়ের মধ্যে তারতম্যানুসারে ভাগ ক’রে দেবেন।

আজকে আমার ব্যক্তিগত প্রয়োজনে ও উপলব্ধি থেকে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের স্বহস্তে লিখিত সত্যানুসরণ গ্রন্থের ২৭ নং বাণীসমূহ একটি লাইন কাহাকেও অন্যায়ের জন্য যদি তুমি শাস্তিবিধান কর, নিশ্চয়ই জেনো-পরমপিতা ঐ শাস্তি উভয়ের মধ্যে তারতম্যানুসারে ভাগ করে দেবেন। নিয়ে আলোচনা করবো। লেখার উদ্দেশ্য কাউকে কষ্ট দেওয়া বা হেয় করার জন্য নয়, তবুও সম্পূর্ণ লেখা পড়ে ও বুঝে যদি কেউ কষ্ট পেয়ে থাকেন তবে তা একান্তই তার ব্যক্তিগত।

মূল লেখা শুরু করার পূর্বে আমরা অমৃত-নিষ্যন্দী স্বতঃ-উৎসারী ২৭ নং বাণীসমূহ সম্পূর্ণটি পড়ে নেই একবার…….

.......

ক্ষমা কর, কিন্তু অন্তরের সহিত; ভিতর গরম রেখে অপারগতাবশতঃ ক্ষমাশীল হতে যেও না।

বিচারের ভার, শাস্তির ভার আপনহাতে নিতে যেও না; অন্তরের সহিত পরমপিতার উপর ন্যস্ত কর, ভাল হবে।
কাহাকেও অন্যায়ের জন্য যদি তুমি শাস্তিবিধান কর, নিশ্চয়ই জেনো-পরমপিতা ঐ শাস্তি উভয়ের মধ্যে তারতম্যানুসারে ভাগ করে দেবেন।
পিতার জন্য, সত্যের জন্য দুঃখ ভোগ করো, অনন্ত শান্তি পাবে।
তুমি সত্যে অবস্থান কর, অন্যায়কে সহ্য করতে চেষ্টা কর, প্রতিরোধ করো না, শীঘ্রই পরম মঙ্গলের অধিকারী হবে।
.........

অনেক কঠিন কঠিন কথা ……..

ক্ষমা কর, কিন্তু অন্তরের সহিত; ভিতর গরম রেখে অপারগতাবশতঃ ক্ষমাশীল হতে যেও না। বিচারের ভার, শাস্তির ভার আপনহাতে নিতে যেও না; অন্তরের সহিত পরমপিতার উপর ন্যস্ত কর, ভাল হবে।

এখন প্রশ্ন আসতে পারে, যার ক্ষমতা আছে সে না হয় ভেতর গরম না রেখে ক্ষমা ক'রতে পারে। কিন্তু যার ক্ষমতা নেই, তার কি হবে? সে কি ক্ষমা করার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে বা কাউকে ক্ষমা করবে না? সহজ কথায় তোমার যদি কোন প্রকার অপারগতা থাকে, তুমি ক্ষমা করতে পারবে না। কেউ যদি কোনো দোষ করে আর তাকে যদি ক্ষমা করতেই হয়। তবে ভেতরে রাগ রেখে ক্ষমা করলে, এ ক্ষমা করার কোন অর্থ হবে না। অনেক কঠিন একটি ব্যপার, চেষ্টা করে দেখতে পারেন।

আমার তো অনেক ক্ষমতা অর্থ, প্রতিপত্তি, লোকবল ইত্যাদি এখন আমার সাথে কেউ যদি অন্যায় করে তবে কি আমি শাস্তি দিতে পারবো না? আমি কেন পরমপিতা বা সৃষ্টিকর্তার উপর ছেড়ে দিবো, তিনি যা করেন তাই হোক? বর্তমান সমাজ তো তাহলে আমাকে কাপুরুষ বলবে। আমরা তো সামাজিক জীব।

এখানে প্রভু যীশু খ্রীষ্টের শেষ সাতটি বাণীগুলোর মধ্যে প্রথমটি খুব মনে পরছে আমার……

ভগবান যীশুর ক্রুশবিদ্ধ অবস্থায় এই প্রথম উক্তিটিকে প্রথাগতভাবে "ক্ষমার বাক্য" বলে বিবেচিত হয়ে থাকে। ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাখ্যা অনুযায়ী এই বাক্যটি ছিল যে, তখনকার রোমান সৈন্যগণ যিশুকে ক্রুশবিদ্ধ করেছিল এবং অন্য আরও যারা তাঁকে ক্রুশবিদ্ধকরণের সঙ্গে জড়িত ছিল তাঁদের ক্ষমার জন্য প্রভু যীশুর পরমপিতার কাছে প্রার্থনা।

পিতা, এদের ক্ষমা করো; কারণ, এরা জানে না এরা কী করছে।

কাহাকেও অন্যায়ের জন্য যদি তুমি শাস্তিবিধান কর, নিশ্চয়ই জেনো-পরমপিতা ঐ শাস্তি উভয়ের মধ্যে তারতম্যানুসারে ভাগ করে দেবেন।

এটা কেমন কথা হলো! মনে করেন আমি এলাকার একজন ক্ষমতাধর ব্যাক্তি বা বিচারপতি, এখন আমার সাথে বা দেশে একজন মানুষ যে কোন অন্যায়-অপরাধ করলো আমি তাকে সমাজসৃষ্ট সংবিধান অনুসারে শাস্তি দিলাম, সেখানে আমাকে কেন সৃষ্টিকর্তা শাস্তি দিবেন? সাধারন দৃষ্টিতে দেখলে বা শুনলে কেমন যেন অযৌক্তিক মনে হয় কথাটি! তাহলে তো সমাজ-রাষ্ট্রে অপরাধ বৃদ্ধি পেতেই থাকবে।

সনাতন ধর্ম-মতের বিশ্বাসী মানুষসহ অনেকেই মনেকরে পূর্বজন্ম কর্মফল অনুসারে মানুষ বর্তমান জীবন ভোগ করে থাকে। পৃথিবীতে যারাই মানব শরীর নিয়ে জন্মগ্রহন করেছেন সে, ভগবান-অবতার-মহাপুরুষ-যোগী-ধ্যানি-সাধরণ মানুষ সকলকেই কর্মফল ভোগ করতে হবে। শ্রীমদ্ভগবদগীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,- কর্মন্যে বাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন। যার বাংলা অর্থ করলে হয় কর্মে তোমার অধিকার আছে, কিন্তু কর্মফল তোমার হাতে নেই। তুমি যেমন ইচ্ছা কর্ম করতে পার কিন্তু তার ফল প্রকৃতির হাতে। প্রকৃতির নিয়ম অনুসারে কর্মের প্রতিফল তোমাকে ভোগ করতেই হবে

অনেকেই হয়তো জানেন না যে, মৃত্যুদণ্ড বা প্রাণদণ্ড হল আইনি পদ্ধতিতে কোনো মানুষকে শাস্তিস্বরূপ একপ্রকার হত্যা করা। যেসব অপরাধের শাস্তি হিসেবে সাধারণত মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়ে থাকে সেগুলোকে বলা হয়ে থাকে "মৃত্যুদণ্ডার্হ অপরাধ"। অতীতকালে প্রায় সকল দেশেই মৃত্যুদণ্ড প্রথা প্রচলিত ছিল। বর্তমানে শুধুমাত্র ৫৮টি দেশ প্রত্যক্ষভাবে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে থাকে। ৯৫টি দেশ এই প্রথা ইতিমধ্যেই অবলুপ্ত করে দিয়েছে। এখন অনেক দেশেই মৃত্যুদণ্ড একটি বিতর্কের বিষয় হিসেবে বিবেচনা করছে। অনেক দেশেই মনে করে একটি অপরাধের জন্য অপরাধী ব্যাক্তিকে শাস্তি না দিয়ে সংশোধনের সুজোগ দিলে মানুষ পরবর্তীতে অপরাধ করা থেকে বিরত হয়।

একটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে, মনে করেন একজন চোর চুরি করলো, তাকে পুলিশ দিয়ে ধরে আনা হলো, সমাজের বিচারপতি তাকে শাস্তিস্বরুপ কিছুদিন জেল-জরিপানা দিলো, এতে কি তার চোর প্রবৃত্বি পরিবর্তন বা সমাজ থেকে চুরি বন্ধ হয়ে গেলো? দেখা যাবে কিছুদিন পর সেই চোর মুক্তি পেয়ে প্রথমে পুলিশের বাড়িতেই আবার চুরি করবে, কারন তাকে তো স্ত্রী-সন্তান নিয়ে খেয়ে বাঁচতে হবে। কিন্তু সমাজ বা রাষ্ট্র যদি চোরকে বুঝাতে সক্ষম হয় চুরি করার ক্ষতিকারক দিকগুলো এবং তাকে বিকল্প একটি কর্মের ব্যবস্থা করে দিতে পারে তাহলে হয়তো এর সমাধান হতে পারে। এরকম অনেক সমাধান ও উদাহরণ আমাদের আশেপাশে দেখা যাবে।

প্রত্যেক ক্রিয়ার একটি সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে। স্যার আইজ্যাক নিউটনের তৃতীয় সূত্র এর ওপর ভিত্তি করেই টিকে আছে এই পৃথিবী, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড। শ্রীশ্রীঠাকুর এখানে বলতে চেয়েছেন, আপনি যদি কাহাকেও অন্যায়-অপরাধের জন্য যদি কোন শাস্তি নির্ধারণ করেন, তাহলে পরমপিতা বা প্রকৃতি প্রদত্ত আপনাকে সেই শাস্তির কিছু অংশ ভোগ করতে হবে। কারন যে অন্যায়ের জন্য আপনি তাকে দোষি সাব্স্ত করছেন, নিরবে ভেবে দেখবেন আপনার এমন কোন কর্ম, এমন কোন কাজ বা এমন কোন একটি পূর্ব ঘটনাই কোন না কোন ভাবে আজকের জন্য দায়ী। তাহলে কি একটি দোষের জন্য দুইপক্ষই দায়ী নয়? তাহলে শাস্তি শুধু একজন পাবে কেন?

পিতার জন্য, সত্যের জন্য দুঃখ ভোগ করো, অনন্ত শান্তি পাবে।
তুমি সত্যে অবস্থান কর, অন্যায়কে সহ্য করতে চেষ্টা কর, প্রতিরোধ করো না, শীঘ্রই পরম মঙ্গলের অধিকারী হবে।

সত্য এসেছে অস্‌ ধাতু থেকে। অস্‌ শব্দের মানে অস্তিত্ব বা বিদ্যমানতা। এখানে সত্যে অবস্থান করার কথা বলা হচ্ছে, মানে ইষ্টকে ধ'রে রাখার কথা বলা হচ্ছে। অস্তিত্বের মূর্ত প্রতীক মানে যাঁকে অবলম্বন ক'রে চললে নিজের অস্তিত্ব বজায় থাকে, বিদ্যমানতা বজায় থাকে, তিনি তোমার ইষ্ট। সত্যে অবস্থান করা মানে ইষ্টের সাথে লেগে থাকা।

পবিত্র বাইবেলে প্রভু যীশু বলেছেন, যে কেহ আপন প্রাণ রক্ষা করে, সে তাহা হারাইবে; এবং যে কেহ আমার নিমিত্ত আপন প্রাণ হারায়, সে তাহা রক্ষা করিবে যুগ-পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ তার প্রিয় সখা-ভক্ত অর্জুনকে গীতা জ্ঞান দান করেছিল কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে। এতো হাজার বছর পর সাধারণ মানুষ এখন তার মর্ম পড়ে অনুধাবন করতে চেষ্টা করছে। এই আধুনিক যুগে এসে বাংলা ১৩১৬ সালে শ্রীশ্রীঠাকুর শ্রদ্ধেয় ভক্ত অতুলচন্দ্র ভট্টাচার্য কে তার অমৃত-নির্দ্দেশ জ্ঞান স্বহস্তে লিখে দিলেন। এখন যা প্রতিটি সৎসঙ্গীর নিত্য পঠিত গ্রন্থ।

আজকের লেখার একবারে উপসংহারে এসে বলতে হয়, অনেকের কাছেই হয়তো বিষয়টি পরিষ্কার নাও হতে পারে, প্রশ্নও থাকতে পার অনেক। লিখতে পারেন আমাকে, যদি কোন ভুল হয়ে থাকে তাও জানাবেন নির্বিধায় নিজেকে আরো ধন্য,  সমৃদ্ধ এবং সংশোধিত করতে পারবো তাহলে। শ্রীশ্রীঠাকুর-এর একটি বাণী- পুরুষোত্তম এর কৃতি আচরণ, তিনি না বুঝালে বুঝে কোন জন। তাঁকে বুঝবার জ্ঞান এখনো আমার হয়নি। শুধুই আমার ক্ষুদ্র উপলব্ধি থেকে বলতে পারি, আমাদের ভালো, মন্দ, মান, জ্ঞান সকল কিছু যদি তাঁর চরনে দিয়ে নিজে শুধু তাঁরই নির্দেশিত কর্ম করে যেতে পারি তাহলে হয়তো সুখে থাকতে পারবো।

শেষে শ্রীশ্রীঠাকুর-এর একটি বাণী মনে পরছে

ভাবছো বসে, চলবে কিসে,
ভাববার তুমি কে?
ভাববার যিনি ভাবছেন তিনি
তুমি ভাবো তাকে।

~ সকলকে জয়গুরু ~