The Web This Blog

Sunday, June 30, 2024

শিশু প্রাজাপত্য-ব্রত ও আমি

সনাতন ধর্ম বা মতানুসারে অনেক পূজা-পার্বণ, ব্রত, উপবাস, নানান বর্ণ-গোত্রের বিভিন্ন নিয়ম কানুন দেখা যায়। বেদ ও বিভিন্ন পুরাণে ভিন্ন ভিন্ন ব্রতাদির কথা নানা ভাবে উল্যেক্ষ পাওয়া যায়। আজ আমি তেমনি একটি ব্রত নিয়ে আমার অভিমত ও অভিজ্ঞতা জানাবো, এখানে যে কোন ভুল বা সংশোধনের বিষয় যদি আপনার চখে আসে তবে আমাকে নির্বিধায় জানাবেন এতে আমি নিজিকে ধন্য মনে করে আরো সমৃদ্ধ করে নিবো। লেখার মূল তথ্যগুলো সৎসঙ্গ-র ঋষি পুরুষ পূজ্যপাদ শ্রীবিদ্যুৎরঞ্জন চক্রবর্ত্তী দাদার সংকলিত “প্রার্থনা” গ্রন্থ থেকে নেয়া হয়েছে।

মূল লেখা শুরু করার পূর্বে কিছু প্রাসঙ্গিক কথা বলতেই হয়, আমরা কেন ব্রত করবো? অন্ন-জল না খেয়ে, বিভিন্ন নিয়ন কানুনের ভিতর দিয়ে নিজের শরীর ও মনকে কষ্ট দিয়ে কিইবা লাভ! ব্রত কথাটির তাৎপর্যই হচ্ছে শ্রেষ্ঠ বা উন্নত কিছুকে বরণ করে তৎকর্ম্মনিষ্ঠ হওয়া এবং তার বিরোধী যা কিছু আছে তাকে অবরোধ করা। অপরদিকে প্রায়শ্চিত্ত হচ্ছে বৃত্তির যে-সাড়ায় মানুষের ভিতর অপকর্ম্মের সৃষ্টি হয়, নিয়মিত মনন ও আচরণে তাতে অধিগমন করে, তা আবিষ্কার করে তাকে এমনতরভাবে নিঃশেষ করা যাতে তা আর কোনক্রমেই নিজের চরিত্রের ভিতর চারিয়ে ঐ অপকর্ম্মের সৃষ্টি না করতে পারে।

শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র বলছেন, মানুষ যখন কদাচারদোষদুষ্ট হয় তখন তার সূক্ষ্ম সাড়াপ্রবণতা হারিয়ে ফেলে। প্রায়শ্চিত্ত মানেই হলো ব্রতপালন দ্বারা পুনরায় চিৎত্বে গমন করা বা নষ্ট সাড়াপ্রবণতাকে আবার নিজের জীননে ফিরিয়ে আনা। শাস্ত্র মতে প্রায়শ্চিত্তের কয়টা অধ্যায় আছে, (ক) খ্যাপন (খ) মার্জন (গ) স্খালন (ঘ) অঘমর্ষণ (ঙ) ঐকান্তিকতার সহিত শ্রেয়ানুশীলন।

ক) খ্যাপন বলতে, নিজের পাপের কথা উপযুক্ত যে কোন দরদী ব্যক্তিত্বের কাছে খুলে বলতে হবে।
খ) মার্জন বলতে, নিজেকে মেজে/পরিষ্কার করে নিতে হবে।
গ) স্খালন বলতে, নিজে নিজে ময়লাবিমুক্ত হওয়া বা Devoid of Dirties।  
ঘ) অঘমর্ষণ বলতে, পাপের চিন্তা একেবারে নাশ করে ফেলা বা পাপে একদম নির্লোভ হওয়া, আসক্তিবিহীন হওয়া।

আমরা যে-কোন রকম প্রায়শ্চিত্তই করি না কেন এই কয়টা নিয়মের মধ্য-দিয়েই যেতেই হবে। এইভাবে ক্রমে ক্রমে নির্লোভ হয়ে আমাদের পাপের প্রতি আসক্তিবিহীন হতেই হবে।সর্বশেষে প্রয়োজন ঙ) ঐকান্তিকতার সহিত শ্রেয়ানুশীলন। এই ধাপগুলি ধারাবাহিক ভাবে পালন ও অতিক্রম করতে পারলেই আমাদের প্রায়শ্চিত্ত করা সম্পূর্ণ হবে।

মনে রাখতে হবে ব্রতাচরণ বা প্রায়শ্চিত্ত কোন শাস্তি বিশেষ নয়। এটি একটি আত্মিক শক্তির বৃদ্ধি ও পাপক্ষয়ের এক মনোবিজ্ঞান ও দেহবিজ্ঞান সম্মত প্রক্রিয়া। মানুষ ঠিক ঠিক প্রায়শ্চিত্ত তখনই করে, যখন সে আর পূর্ব্ব পাপের পুনরাবৃত্তি করে না। আত্মশক্তির উদ্বোধন ও বিকাশের জন্য শ্রীশ্রীঠাকুরের বিধিনির্দিষ্ট ব্রত ও প্রায়শ্চিত্তাদি প্রয়োজনানুসারে আমাদের অবশ্যই পালনীয়।

যে কোন ব্রত শুরু করার আগের দিন নিষ্ঠার সাথে ব্রতধারীকে সংযমে থাকতে হয়। সংযমটা হলো একরকম ব্রতের প্রস্তুতি-পর্ব্ব। সংযমের দিন সৎসঙ্গীদের সকালে নিত্য করণীয় জপ-ধ্যান, ইষ্টভৃতি, স্বস্ত্যয়নী, প্রার্থনা ইত্যাদি করার পর শুচিশুদ্ধ অন্তঃকরণে শ্রীশ্রীঠাকুরের উদ্দেশ্যে প্রণামী ও ভোজ্যাদি নিবেদন করতে হবে। তারপর পূর্ব্বাহ্নে হবিষ্যান্ন অর্থাৎ প্রথমে আতপচালে ডাল বাটা, কাঁচাকলা দিয়ে ফেনশুদ্ধ ভাত ঘি ও সৈন্ধব লবণসহ, পরে দুধ-কলা-গুড়সহ খেয়ে সারাদিন আর কিছু না খেয়ে সংযম পালন করতে হবে। তেমন প্রয়োজন হলে বা অশক্ত হলে রাত্রে একটু দুধ খাওয়া যেতে পারে। এইভাবে সারাদিন থেকে পরের দিন থেকে সঙ্কল্পিত ব্রত আরম্ভ করতে হবে। সংযমের প্রধান জিনিষ হল নিজের মনটাকে ইষ্টঝোঁকা করে তোলা ও নিজেকে নামময় করে তোলা।

বার দিনের প্রাজাপত্য-ব্রত এর কথা বেদে উল্যেক্ষ আছে, বিভিন্ন কারনে আমাদের এই ব্রত পালন করতে হয়। শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র শিশু প্রাজাপত্য-ব্রত করতে বলেছেন আমাদের। শিশু প্রাজাপত্য-ব্রত চারদিন ধরে করতে হয়। প্রথম দিন পূর্ব্বাহ্নে হবিষ্যান্ন, দ্বিতীয় দিন অপরাহ্নে হবিষ্যান্ন, তৃতীয় দিন অযাচিত- হবিষ্যান্ন অর্থাৎ না চাইতেই যদি কেউ হবিষ্যান্নে গ্রহণযোগ্য ভোজ্য দেয় তা' দিয়ে হবিষ্যান্ন এবং চতুর্থ দিন নিরম্বু উপবাস থেকে পঞ্চম দিন প্রাতে যথাসাধ্য ইষ্টপ্রণামী নিবেদন করে ব্রত উদযাপন করতে হবে।

২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রিয়পরম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র সৎসঙ্গ ফাউন্ডেশনের ঋত্বিক সম্মেলনে পূজনীয় শ্রীবিনায়ক চক্রবর্ত্তী-দাদা শিশু প্রাজাপত্য-ব্রত বিষয়ক নানান আলোচনা করলেন এবং সকল কর্মীদের নির্দেশ দিলেন বৎসরে একবার এই ব্রত করতে হবে। অনেক কর্মীই তখন মনে মনে এই ব্রত করার সিদ্ধান্ত নেয় তাদের মধ্যে আমিও একজন। কিন্তু সমস্যা হলো ৫-৬ দিন ছুটি নিয়ে মন্দিরে থেকে এই ব্রত করতে হবে। কি করা যায় ভাবতে ছিলাম……….

আমি ও নারায়ন চন্দ্র চন্দ (সহ-প্রতি ঋত্বিক) গেন্ডারিয়া, ঢাকা থেকে প্রথম শিশু প্রাজাপত্য ব্রত করার সিন্ধান্ত নিলাম। নিয়মানুসারে আমাদের ঋত্বিক সচিব শ্রীকৃষ্ণ চন্দ্র চক্রবর্তী (সহ-প্রতি ঋত্বিক) দাদার তত্বাবধানে এই ব্রত সম্পূর্ণ করতে হবে। তাই করা হলো, শ্রদ্ধেয় ঋত্বিক সচিব মহোদয় একটি তালিকা করে দিলেন কখন কি কি নিয়ম পালন করতে হবে আমাদের। আমরা সিন্ধান্ত নিলাম ঈদ-উল-আযহা এর বন্ধে গেন্ডারিয়া থেকে আমরা ব্রত করবো।

এখন কে কে করবে তার খোজ করতে শুরু করলাম আমরা। তখন কেরাণীগঞ্জে আমাদের মন্দিরের দ্বিতীয় তলা সম্পূর্ণ হয়েছে। তাই ব্রত দ্বিতীয় তলাতেই শুরু করলাম আমরা। তারিখ ঠিক করলাম ঈদ-উল-আযহার পরদিন থেকে শুরু হবে তাই ঈদের দিন আমরা সবাই একত্রে মন্দিরে থাকবো। ১১ই জুলাই ২০২২ ইং থেকে ১৪ই জুলাই ২০২২ ইং আমাদের শিশু প্রাজাপত্য ব্রত চললো। 

যারা যারা করেছিলাম ……….

শ্রীনারায়ন চন্দ্র চন্দ (সহ-প্রতি ঋত্বিক)
শ্রীবিধান চন্দ্র শীল (সহ-প্রতি ঋত্বিক)
শ্রীপিযুষ কান্তি দাস (সহ-প্রতি ঋত্বিক)
শ্রীবিমল দাস (সহ-প্রতি ঋত্বিক)
শ্রীস্বপন কুমার বিশ্বাস (অধ্বর্য্যু), নরসিংদি
শ্রীরাম কৃষ্ণ সরকার (যাজক) আমি

ত্রিসন্ধ্যা স্নান করতে হবে, স্নানের সময় সাবান, শ্যাম্পু ও তেল ব্যবহার করা যাবে না, তোষক-বালিসে শ্বয়ন করা যাবে না, মা ব্যাতিত কোন নারীর মুখ দর্শন-কথা বলা নিষিদ্ধ ইত্যাদি।

আমাদের যা যা করতে হতো ……

প্রতিদিন ব্রাহ্মমুহূর্তে নিদ্রাত্যাগ করার পর থেকে। (সময় কিছুটা পরিবর্তন হতে পারে, এখানে উদাহরন স্বরুপ দেওয়া হল)

নাম ধ্যান ৪.০০ মিনিট পর্যন্ত
শয্যাত্যাগ ভোর ৪.০০ মিনিট
প্রাকৃতিক কাজ ৪.০১-৪.৩০ মিনিট
নামজপ ও ইষ্টভৃতি ৪.৩১-৪.৫৩ মিনিট
প্রার্থনা ভোর ৪.৫৪-৫.২৪ মিনিট
স্বাধ্যয় ভোর ৫.২৫-৭.০০ মিনিট
শব ধ্যান সকাল ৭.০১-৭.০৫ মিনিট
মৌনব্রত সকাল ৭.০৬-৭.৩০ মিনিট
ইষ্টালোচনা ৭.৩১-৮.০০ মিনিট
ধ্যান সকাল ৮.০১-৮.৪৫ মিনিট
স্বাধ্যয় সকাল ৮.৪৬-৯.৩০ মিনিট
মৌনব্রত ৯.৩১-১০.০০ মিনিট
নামধ্যান ১০.০১-১০.৪৫ মিনিট
স্বাধ্যয় ১০.৪৬-১১.৩০ মিনিট
ইষ্টালোচনা সকাল ১১.৩১- দুপুর ১২.১৫ মিনিট
নাম-ধ্যান দুপুর ১২.১৬-১.০০ মিনিট
মৌনব্রত দুপুর ১.০১-২.৩০ মিনিট
ইষ্টালোচনা বিকেল ২.৩১ -৪.০০ মিনিট
স্বাধ্যয় বিকেল ৪.০১-৫.০০ মিনিট
শবধ্যান বিকেল ৫.০১-৫.০৬ মিনিট
নাম-ধ্যান বিকেল ৫.০৬ -৫.৫০ মিনিট
মৌনব্রত বিকেল ৫.৫১-৬১৫ মিনিট
প্রার্থনার প্রস্তুতি গ্রহণ বিকেল ৬.১৫-৬.৫০ মিনিট
সান্ধ্যকালীন প্রার্থনা সন্ধ্যা ৬.৫১-৭.২০ মিনিট
ইষ্টালোচনা সন্ধ্যা ৭.২১-৭.৫০ মিনিট
নাম-ধ্যান রাত ৭.৫১-৮.৩৫ মিনিট
স্বাধ্যয় রাত ৮.৩৬-৯.০০ মিনিট
শবধ্যান রাত ৯.০১-৯.০৬ মিনিট
ইষ্টালোচনা রাত ৯.০৬-৯.৩০ মিনিট
নাম-ধ্যান রাত ৯.৩১-১০.১৫ মিনিট
শয্যাগ্রহণ ১০.১৬ মিনিট
নিদ্রা ব্রাহ্মমুহূর্ত পর্যন্ত

১৫ ই জুলাই সকালে প্রার্থনা শেষ করে জল গ্রহনের মাধ্যামে শেষ হয় আমাদের ১ম শিশু প্রাজাপ্রত্য ব্রত।

***************************

সময় ঘুরে আবার ২০২৩ এর ঈদ-উল-আযহা চলে এলো আমাদের দ্বিতীয় শিশু প্রাজাপ্রত করার দিন। ঈদ এর বন্ধে গেন্ডারিয়া থেকে আমরা, ৩০শে জুন ২০২৩ ইং থেকে ০৩রা জুলাই ২০২৩ ইং আমাদের ব্রত করলাম। তৃতীয় তলায় আলাদা আলাদা কক্ষে। 

যারা যারা করেছিলাম ……….

শ্রীনারায়ন চন্দ্র চন্দ (সহ-প্রতি ঋত্বিক)
শ্রীবিধান চন্দ্র শীল (সহ-প্রতি ঋত্বিক)
শ্রীপিযুষ কান্তি দাস (সহ-প্রতি ঋত্বিক)
শ্রীবিমল দাস (সহ-প্রতি ঋত্বিক)
শ্রীরাম কৃষ্ণ সরকার (অধ্বর্য্যু) আমি
শ্রীনারায়ন চক্রবর্ত্তী (স্বস্তয়নী)
শ্রীবলরাম সরকার
শ্রীসৌরভ পোদ্দার পাপ্পু

আরো কয়েকজন গুরুভাই আমাদের কয়েকদিন আগে ও পরে শিশু প্রাজাপত্য ব্রত শুরু করেছিলেন।

******************

আমার তৃতীয় শিশু প্রাজাপত্য ব্রত সম্পন্য করি, ১৮শে জুন ২০২৪ ইং থেকে ২১শে জুন ২০২৪ ইং ৩য় তালায় আলাদা আলাদা কক্ষে, একই ভাবে ঈদ-উল-আযহা এর বন্ধে

যারা যারা করেছিলাম ……….

শ্রীনারায়ন চন্দ্র চন্দ (সহ-প্রতি ঋত্বিক)
শ্রীবিধান চন্দ্র শীল (সহ-প্রতি ঋত্বিক)
শ্রীবিমল দাস (সহ-প্রতি ঋত্বিক)
শ্রীবিনন্দ সাহা রায় (সহ-প্রতি ঋত্বিক), নেত্রকোনা
শ্রীরাজিব কর্মকার (অধ্বর্য্যু), কক্সবাজার
শ্রীরাম কৃষ্ণ সরকার (অধ্বর্য্যু) আমি

আরো কয়েকজন গুরুভাই আমাদের কয়েকদিন আগে ও পরে শিশু প্রাজাপত্য ব্রত শুরু করেছিলেন।

সবাই আমার জন্য আশির্বাদ করবেন আমি যেন পরমপিতার একনিষ্ঠ সেবক হয়ে উঠতে পারি।

No comments:

Post a Comment