করার পথে চলতে গেলে
এতই ঠকা শেখাই দায়,
অতো ঠকে শিখতে গেলে
জীবনে কি পাড়ি পায়?
শিখেছে যে তা’র কাছে তাই
শেখায় শরণ নেওয়াই ভাল,
নইলে যে তোর বোকা সাহস
ভরজীবনই ঠকিয়ে গেল।
উপরের কথা বা বানীটি যিনি দিয়েছেন আমার জীবনের একমাত্র উপাস্য, আরধ্য দেবতা প্রিয়পরম শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্র। আজকের লেখার সাথে বানীটির বেশ মিল আছে বলেই এই বানীটি দিয়ে আমার লেখা শুরু করলাম।
জ্ঞান অর্জনের কোন শেষ নেই। জন্ম থেকে আ-মৃত্যু মানুষ কোন না কোন ভাবে শিক্ষা গ্রহন করেই। নবি কারীম (সঃ) বলেছেন, "দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন কর।"
সময়ের সাথে সাথে মানুষের মনে প্রতিনিয়ত কোন না কোন প্রশ্নের সৃষ্টি হতেই থাকে। শিক্ষা গ্রহন করার বিষয়টি সম্পূর্ন ব্যক্তির নিজস্ব অভিরুচির উপর নির্ভর করে। সবাই একরকম ভাবে শিক্ষা গ্রহন করতে স্বাচ্ছন্দ বোধ নাও করতে পারে। কেউ শিখে Practically, কেউবা চোখে দেখে, কেউ বই পড়ে, কেউবা অভিজ্ঞতা অনুসারে, কেউ চিন্তার মাধ্যমে, কেউবা আবার বিশ্বাসে আরো অনেক পদ্ধতি থাকতে পারে। তবে আমার মতে শিক্ষা গ্রহনের সবচেয়ে সহজ ও জনপ্রিয় পন্থা হচ্ছে শিক্ষক ও গুরুর মাধ্যমে। একজন শিক্ষক বা গুরুই ছাত্রের ধরন বুঝে তাকে শিক্ষা দিতে পারেন।
অপরদিকে, শিক্ষার একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হচ্ছে স্বশিক্ষা। নিজে নিজে যা শিখে সেই শিক্ষা ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা মানুষের খুব কমই থাকে। যে শিক্ষা আমরা সাধারনত নিজের অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বা জীবনে ঘটে যাওয়া বড় কোন ঘটনার মাধ্যমে শিখে থাকি। প্রচলিত একটি কথা আছে, "তুমি শিখছিলা কোথায়? আমি ঠেকছিলাম যেথায়।" এই ঠেকে শেখাকেই এক কথায় স্বশিক্ষা বলা যেতে পারে।
প্রতিটি মানুষের কাছে নিজ পরিবার হচ্ছে প্রধান শিক্ষাক্ষেত্র। পিতা-মাতাই তার প্রথম শিক্ষক। আমার জীবনে মা জীবনের তেমনই শিক্ষক। আমার জীবনের এমন কোন ঘটনা নেই যা আমার মা-এর সাথে আলোচনা করিনি। আমার মাকে কতটুকু ভালবাসি তা জানিনা কিন্তু তার খুসির জন্য যেকোন কিছু ত্যাগ করতি রাজি আছি।
স্বর্গীয় কালি পদ সরকার আমার ঠাকুর দাদা (Grandfather) ১৯৯৯ সালের ১৭ ই জানুয়ারী তিনি মারা যান। তিনি ছিলেন আমার প্রথম পারিবারিক আদর্শ। তিনিই আমার জীবনের বেশীর ভাগ গুনের বীজ রোপন করে দিয়েছিলেন। আমার দুঃখ কিশোর বয়সেই আমি তাকে হারিয়েছি, বেশি কিছু শিখতে পারিনি আর। ধর্ম, বিজ্ঞান, মানবিকতা সহ অনেক কিছুরই ভিত্তি তার হাত ধরেই। তিনিই আমাকে শিখেয়েছিলেন কিভাবে মটর ও ককসিট দিয়ে খেলনা লঞ্চ বানিয়ে নদিতে চালানো যায়। কিভাবে নিজের কাজ নিজেকেই করতে হয়। তিনি বলতেন যতক্ষন নিজের সামর্থ থাকে ততক্ষন অন্যের কাছ থেকে কোন প্রকার সাহায্য নেয়া নিজের যোগ্যতাকেই অপমান করা। আজ তিনি আমাদের মাঝে নেই, যেখানেই থাকুন ভাল থাকুন এই প্রার্থনা।
রক্তাক্ত প্রান্তর (১৯৬২), নাটকে শহীদ মুনীর চৌধুরী বলেছেন, “মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়, কারণে অকারণে বদলায়।”
জীবনের দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করার পর আজ আমার সৃতির ভান্ডার থেকে যতটুকু মনে আছে তা থেকে ছাত্র জীবনের কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মজীবনের কয়েকজন Boss সম্পর্কে কিছু লেখার চেষ্টা করছি। আজ আমি যেখানে অবস্থান করছি সেখানে তাদের প্রত্যেকের ভূমিকা অপরিসীম। তাদের প্রত্যেকের প্রতি রইল আমার স্বশ্রধ্য প্রনাম ও ভালোবাসা।
১। মোঃ খালেক স্যারঃ- আমাদের পারিবারিক শিক্ষক ছিলেন খালেক স্যার। তিনি গেন্ডারিয়ার উপজেলা সমাজসেবা অধিদপ্তরে চাকরি করতেন পাশাপাশি আমাদের ছোট কাকা এবং আমাদের সকল ভাই-বোনদের পড়াতেন। আমার জীবনের প্রথম হাতেখড়ি থেকে চতুর্থ শ্রেনী পর্যন্ত তিনি পড়িয়েছিলেন। এই মূহর্তে স্যারের যে বিষয়টি আমার খুব মনে পরছে, তিনি যেদিন বিদ্যালয় থেকে নতুন বই দিতো সেই দিন পড়াতেন না। সেই দিন থাকতো শুধু বই পরিচিতি। প্রতিটি নতুন বই এর গন্ধ শুকতে ও বইয়ের ছবি গুলো দেখতে দিতেন আর বলতেন আগে বইকে ভালবাসতে শিখো তারপর কাল থেকে পড়ালেখা।
২। অসিম কুমার ভৌমিকঃ- অসিম স্যার মূলত ইংরেজীর শিক্ষক ছিলেন। আমি তার কাছে ৬ষ্ঠ থেকে ১০ম (এস এস সি) শ্রেনী পর্যন্ত সকল বিষয় পড়েছিলাম। তার একাদশ শ্রেনীর ইংরেজী পড়ানোর পদ্ধতি ছিল অসাধরন। কিভাবে ইংরেজীর কোন শব্দ ডিকশেনারী থেকে বের করতে হয় তার কাছ থেকেই শেখা।
৩। বিধান বিশ্বাসঃ- বিধান স্যার এর কাছে আমি নবম ও দশম শ্রেনীর অংক করতাম। তখন কেন যেন মনে হতো তিনি একবার যে অংক শিখাতেন তা আর ভুলার কোন উপায় নেই। যে কোন অংক কি ভাবে সহজে মনে রাখা যায় তিনিই জানতেন। আমরা ছাত্র-ছাত্রীরা তাকে অংকের জাহাজ বলতাম।
৪। রুহুল আমিন হাওলাদারঃ- হাওলাদার স্যার ছিলেন আমাদের গেন্ডারিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের শিক্ষক। তার কাছে কয়েক মাস ব্যাচে বিজ্ঞান ও অংক পড়েছিলাম। তার পড়ানোর পদ্ধতির কারনেই আমার জীববিজ্ঞানের প্রতি একপ্রকার ভালোবাসা জন্মায়। ভেবেছিলাম বড় হয়ে শুধু জীববিজ্ঞান নিয়ে লেখা পড়া করবো। যে স্বপ্ন এখনো স্বপ্নই রয়ে আছে।
৫। বিবেকানন্দ বিশ্বাসঃ- বিবেক স্যার আমাদের পারিবারিক আত্মীয় (দাদা) হয়। ছোট বেলা থেকেই তার সাথে আমার সম্পর্ক। তার কাছে একাদশ থেকে এম,কম শ্রেনী পর্যন্ত পড়ি। তার হিসাব বিজ্ঞান পড়ানো ছিল এতাটাই সাবলীন ও অপ্রতিদন্ধী যে তখন আশে পাশের এলাকা থেকেও প্রচুর ছাত্র-ছাত্র আসতো। তিনি আমাকে ফ্রী পড়াতেন। তখনই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমিও যদি শিক্ষকতা করি তখন আমিও কিছু ছাত্র ফ্রী পরাবো এবং সেই কারনে আমাদের কচিং সেন্টারে কিছু গরিব ছাত্রদের সবসময় ফ্রী পড়তাম।
৬। অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ কায়কোবাদঃ- BUET পরিচালিত IAC থেকে আমি ২০১১ সালে Web Design and Application Development কোর্সটি করি। ড. কায়কোবাদ স্যারকে আমার টেলিভিশন ও বিভিন্ন কম্পিউটার মেলায় অনেকবার দেখার সুযোগ হয়েছিল। যখন কোর্সটি ভর্তি হই তখন মনে করেছিলাম স্যার বোধহয় আমাদের ক্লাস করাবেন। সেই সুযোগ আর হয়নি। তবে সৌভাগ্যক্রমে আমাদের Certificate প্রদানের দিন স্যার এসেছিলেন। স্যারের একটি কথা আমার খুব মনে পরে। তখন তিনি তার বক্তিতায় বলেছিলেন, “এই অল্প সময়ে তোমরা এখান থেকে যা শিখলে তা যদি তোমরা কাজে লাগাতে পারো সেটাই তোমাদের পরিশ্রমের সার্থকতা। সব সময় মনে রেখো তোমরা আজ পৃথিবী থেকে যা গ্রহন করলে বা শিখলে তা যেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য কাজের মাধ্যমে কয়েকগুন ফেরত দিতে পার। ”
{শেষ অংশ}
No comments:
Post a Comment