~~
প্রথম
অংশ ~~
আমাদের
হিন্দু
সমাজে প্রধান
চারটি বর্ণ প্রচলিত আছে। (১)
ব্রাহ্মণ
(২)
ক্ষত্রিয়
(৩)
বৈশ্য
ও (৪)
শূদ্র।
সাধারনত
ধরে নেয়া হয় বা বর্তমানে প্রচলিত
হয়ে গেছে যে একজন
ব্রাহ্মণের সন্তানই
ব্রাহ্মণ,
ক্ষত্রিয়ের
সন্তানই
ক্ষত্রিয়,
বৈশ্যের
সন্তানই
বৈশ্য,
শূদ্রের
সন্তানই
শূদ্র হবে।
আসলে ঘটনাটি কি
তাই?
এটাই
আজকে জানার চেষ্টা করবো।
কোন
বর্ণ বা প্রথাকে আঘাত করার
জন্য নয়। নিজের জানার চেষ্টা
থেকেই লেখার উৎসাহ।
শুরুতেই
যুগোপুরুষোত্তম পরমপ্রেমময়
শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের
একটি বাণী দিয়ে শুরু করছি-
শূদ্রই
তো জাতির চাকা,
বৈশ্য
জোগায় দেশের টাকা
ক্ষত্রিয়েরা
রাজার জাত,
সবার
পুরণ বিপ্র ধাত।
বর্ণপ্রথা
সম্পর্কে যুগোপুরুষোত্তম
ভগবান
শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার
জ্ঞানযোগ অধ্যায়ে ত্রয়োদশ
শ্লোকে
বলেছেন :-
চাতুর্বর্ণ্যং
ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ
।
তস্য
কর্তারমপিমাং বিদ্ব্যকর্তারসব্যয়ম।
অর্থাৎ,
প্রকৃতির
তিনটি গুণ ও কর্ম অনুসারে আমি
মানব-সমাজে
চারটি বর্ণবিভাগ সৃষ্টি করেছি।
আমি এর স্রষ্টা হলেও আমাকে
অকর্তা এবং অব্যয় বলে জানবে।
এই
সম্পর্কে জানতে হলে প্রথমেই
আমাদের সহজ ভাষায় জানা উচিৎ
ব্রাহ্মণ,
ক্ষত্রিয়,
বৈশ্য
বা শূদ্র কারা~
ক)
ব্রাহ্মণঃ-
যিনি
বা যারা
ব্রহ্মজ্ঞানে
বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন এবং
যিনি
সত্ত্বঃ গুণ দ্বারা প্রভাবিত।
মনুসংহিতার
বর্ণনা মতে
ব্রাহ্মণ ‘ব্রহ্মা’-এর
মুখ থেকে সৃষ্টি হয়েছিল।
তাই তারা ঈশ্বরের বা
ব্রহ্মার
পক্ষ থেকে কথা বলতে পারেন।
‘ব্রহ্মা’ ব্রাহ্মণদের জন্য
ছয়টি কাজ বা
দায়িত্ব
দিয়েছেন। ‘‘অধ্যাপন মধ্যয়নং
সজমং জাজসং তথা দানং প্রতিগ্রহেবওব
ব্রাহ্মণা নাম কলপয়ৎ।’’
যার
অর্থ সৃষ্টিকর্তা
বলছেন
ব্রাহ্মণরা
অধ্যায়ন,
অধ্যাপনা,
যজন,
যাজন,
দান
এবং প্রতিগ্রহ এই ছয়টি কর্তব্য
পালন
বা ধারন
করবেন।
খ) ক্ষত্রিয়ঃ- যিনি বা যারা শাসক বা যোদ্ধা সম্প্রদায়ভুক্ত এবং যিনি রজঃ গুণ দ্বারা প্রভাবিত।
মনুসংহিতার
বর্ণনা মতে ক্ষত্রিয়রা
যেহেতু ঈশ্বরের বা
ব্রহ্মার
বাহু
থেকে সৃষ্টি হয়েছে,
তাই
তাদের কাজ হল প্রজা প্রতিপালন,
দান,
অধ্যয়ন
ও কর্তব্য পালন করা। ‘‘প্রজানং
রক্ষণং দান মজ্যিধ্যিয়ন
সেবচ,
বিষয়ে
প্রশক্তির ক্ষত্রিয়ানাদ
সমাগত।’’ যার
অর্থ সৃষ্টিকর্তা
ক্ষত্রিয়দের জন্য প্রজা
প্রতিপালন,
দান,
অধ্যায়ন,
যজ্ঞ
ইত্যাদি কর্তব্য নির্ধারন
করছেন।
গ) বৈশ্যঃ- যিনি বা যারা ব্যবসায় সম্প্রদায়ভুক্ত এবং যিনি রজঃ ও তমঃ গুণ দ্বারা প্রভাবিত।
মনুসংহিতার
বর্ণনা
মতে,
‘‘পশু
নাং রক্ষণং দান মজ্যিধ্যয়ন
সেবচ,
বণিক
পথং কুসীদঞ্চ বৈশ্যম্য কৃষি
সেবচ।’’
যার অর্থ সৃষ্টিকর্তা বৈশ্যের জন্য পশু পালন আর রক্ষা, দান, যজ্ঞ, অধ্যায়ন, বাণিজ্য, কৃষিকর্ম এ সব কর্তব্যের পকিল্পনা করছেন।
যার অর্থ সৃষ্টিকর্তা বৈশ্যের জন্য পশু পালন আর রক্ষা, দান, যজ্ঞ, অধ্যায়ন, বাণিজ্য, কৃষিকর্ম এ সব কর্তব্যের পকিল্পনা করছেন।
ঘ) শূদ্রঃ- যিনি বা যারা শ্রমজীবী সম্প্রদায়ভুক্ত ব্যক্তি এবং যিনি তমঃ গুণ দ্বারা প্রভাবিত।
মনুসংহিতায়
বর্ণনা মতে শূদ্ররা
ঈশ্বরের বা ব্রহ্মার
পা থেকে সৃষ্টি হয়েছে,
তাই
এ বর্ণের লোকদের একমাত্র কাজ
হল ব্রাহ্মণ,
ক্ষত্রিয়
ও বৈশ্যের সেবা করা। ‘‘একসেব
তুশুদ্রস্য প্রভু কর্ম সমদিশৎ
এতষসেব বর্ণনাং শুশ্রুষামন
সুয়ায়া।’’ যার অর্থ
সৃষ্টিকর্তা শূদ্রের জন্য
একটি মাত্র কর্তব্য পরিকল্পনা
করলেন,
আর তাহলো
ব্রাহ্মণ,
ক্ষত্রিয়
ও বৈশ্য এই তিন বর্ণের লোকদের
সেবা করা এবং তাদের আদেশ পালন
করা।
দ্বাপার
যুগে দেখা যায় জাতিভেদ প্রথা
ছিল শুধু
গুণ
ও কর্মগত,
তখনও
জন্ম গত ভাবে এই জাতিভেদ প্রথা
সম্পূর্ন
গড়ে ওঠেনি। উদাহরন
হিসবে ভগবান
শ্রীকৃষ্ণের
লৌকিক পিতা বসুদেব ছিলেন একজন
ক্ষত্রিয় রাজা,
তাঁর
জ্যেষ্ঠভ্রাতা
গর্গমুনি ছিলেন বিপ্র তথা
ব্রাহ্মণ,
আবার
তাঁর অন্য জ্ঞাতি কাকা নন্দ,
উপনন্দ
ছিলেন দুই
জনেই কর্ম
সূত্রে গোয়ালা অর্থাৎ
বৈশ্য।
ঋগবেদের
১.১১৩.৬
(মন্ডল-সূক্ত-শ্লোক)
শ্লোকের
ভাবার্থ অনুসারে,
“একজন
জ্ঞানের উচ্চ পথে ব্রাহ্মণ,
অপরজন
বীরত্বের গৌরবে ক্ষত্রিয়,
একজন
তার নির্দিষ্ট পেশাভিত্তিক
বৈশ্য,
আরেকজন
সেবার পরিশ্রমে শূদ্র। সকলেই
তার ইচ্ছামাফিক পেশায়,
সকলের
জন্যই ঈশ্বর জাগ্রত।”
ঋগবেদের ৯.১১২.১ শ্লোকের ভাবার্থ অনুসারে, “একেকজনের কর্মক্ষমতা ও আধ্যাত্মিকতা একেক রকম আর সে অনুসারে কেউ ব্রাহ্মণ কেউ ক্ষত্রিয় কেউ বৈশ্য কেউ শূদ্র।”
একজন শূদ্রের পূত্র যেমন ব্রহ্মজ্ঞানে দীক্ষিত হয়ে ব্রহ্ম জ্ঞান লাভ করে তাহলে সে ব্রাহ্মণ হবে এবং ঠিক সেভাবেই সেই ব্রাহ্মণের পুত্র যদি শ্রমবিক্রি করে জীবনযাপন করে তাহলে সে শূদ্র হবে। কারন এই যে বর্ণ বিভাজন এটা কিন্তু জন্মভেদে নয় কর্মভেদে। গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যে বর্ণ বিভাগের কথা বলেছিলেন সেই বর্ণ বিভাগ ও পৌরাণিক হিন্দু ধর্মের জাতিভেদ প্রথা কিন্তু এক নয়। মানসিকতার বিচারে দেখলে বর্ণভেদ সংস্কারগত ও কর্মের দ্বারা গুণ অর্জনের মাধ্যমে পরিবর্তনশীল। অপরদিকে জাতিভেদ প্রথা হচ্ছে সুবিধাবাদী, কিছু স্বার্থপর মানুষের সৃষ্টি জন্মগত ও অপরিবর্তনীয়। জাতিভেদ প্রথার নিয়ম অনুসারে দেখা যাচ্ছে শূদ্রের ঘরে জন্মগ্রহণ করলেই তিনি শূদ্র, আর ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মগ্রহণ করলেই তিনি ব্রাহ্মণ বলেই গণ্য হচ্ছে।
ব্রাহ্মণ
সম্পর্কে,
ঋগবেদের
৭.১০৩.৮
নং শ্লোকে বলা হয়েছে,
“যে
ঈশ্বরের প্রতি গভীরভাবে
অনুরক্ত,
অহিংস,
সত্য,
নিষ্ঠাবান,
সুশৃঙ্খল,
বেদ
প্রচারকারী,
বেদ
জ্ঞানী সেই ব্রাহ্মন।”
ক্ষত্রিয়
সম্পর্কে,
ঋগবেদের
১০.৬৬.৮
নং শ্লোকে বলা হয়েছে,
“দৃঢ়ভাবে
আচার পালনকারী,
সত্কর্মের
দ্বারা শুদ্ধ,
রাজনৈতিক
জ্ঞান সম্পন্ন,
অহিংস,
ঈশ্বর
সাধক,
সত্যের
ধারক ন্যায়পরায়ন,
বিদ্বেষমুক্ত
ধর্মযোদ্ধা,
অসত্
এর বিনাশকারী সেই ক্ষত্রিয়।”
বৈশ্য সম্পর্কে, অথর্ববেদের ৩.১৫.১ নং শ্লোকে বলা হয়েছে, “দক্ষ ব্যবসায়ী দানশীল চাকুরীরত এবং চাকুরী প্রদানকারী সেই বৈশ্য।”
শূদ্র সম্পর্কে, ঋগবেদের ১০.৯৪.১১ নং শ্লোকে বলা হয়েছে, “যে অদম্য, পরিশ্রমী, অক্লান্ত জরা যাকে সহজে গ্রাস করতে পারেনা, লোভমুক্ত কষ্টসহিষ্ণু সেই শূদ্র।”
এজন্যেই পবিত্র ঋগবেদের ৫.৬০.৫ নং শ্লোকে বলা হয়েছে, “অজ্যেষ্ঠাসো অকনিষ্ঠাসো এতে সংভ্রাতরো বাবৃধূঃ সৌভগায়। যুবা পিতা স্বপা রুদ্র এযাং সুদুঘা পুশ্নিঃ সুদিনা মরুদ্ভ্যঃ।”
ভাবার্থ,
কর্ম
ও গুনভেদে কেউ ব্রাহ্মণ,
কেউ
ক্ষত্রিয়,
কেউ
বৈশ্য,
কেউ
শূদ্র। তাদের মধ্যে কেহ বড়
নয় কেহ ছোটও নয়।ইহারা ভাই
ভাই। সৌভাগ্য লাভের জন্য ইহারা
প্রযত্ন করে। ইহাদের পিতা
তরুন শুভকর্ম ঈশ্বর এবং জননীরুপা
প্রকৃতি।পুরুষার্থী সন্তানই
সৌভাগ্য প্রাপ্ত হন।
কলিযুগের
প্রথম থেকে ভারতীয়
হিন্দু
সমাজে ধীরে ধীরে ক্ষত্রিয়
প্রাধান্য শেষ হয়ে বিপ্র
প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা
শুরু হয়। সেই
সময় কিছু সুবিধাবাদী
স্বার্থপর রাজা
এবং ধর্মগুরুরা
নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমান
করতে এবং
অজ্ঞ ও সাধারণ
ধর্মভীরু মানুষদের যুগ যুগ
ধরে বংশপরাম্পরায় মানস অর্থনৈতিক
শোষণ করার
জন্যে এই জাতিভেদ প্রথাকে
জন্মগত বলে ঘোষণা ও
প্রতিষ্ঠা করে।
তখন থেকেই তারা
মূলত
শূদ্র ও নারীদের বিভিন্ন
প্রকার ধর্মীয়,
সামাজিক,
অর্থনৈতিক
এমনকি মানবিক অধিকার পর্যন্ত
হরণ করে বিভিন্ন ধরণের বিধি-নিষেধ
আরোপ করতে থাকেন।
তারাই আইন কর ঘোষণা
করেন বেদ,
ব্রহ্ম
ও ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব সকল
মনুষকে
মানতে হবে। যারা এই
নিয়ম মানবে তারা
আস্তিক আর যারা মানবে না তারা
নাস্তিক। ইতিহাস
থেকে পাওয়া যায় সেই
সময়ে তারাই
বেদ লিপিবদ্ধ করে ও তাদের এই
সব বিধি-নিষেধ
স্বয়ম্ভূব মনু রচিত বলে
‘মনুসংহিতা’র
নামে সংকলিত করে।
No comments:
Post a Comment