The Web This Blog

Wednesday, April 21, 2021

জীবনকে যে-ভাবে বলি দেবে, নিশ্চয় তেমনতর জীবন লাভ ক'রবে


সত্যানুসরণ যতবার পড়ি ততবারই নতুন থেকে নতুনত্বর লাগে, মনে হয় এই কথাগুলোকি আগে পরেছিলাম? কয়কদিন আগে মন্দিরে আমাকে আলোচনা করতে বলাহয়েছিল “জীবনকে যে-ভাবে বলি দেবে, নিশ্চয় তেমনতর জীবন লাভ ক'রবে”। তাই ভাবলাম কথাগুলো লিখে রাখি যদি কারো কোন কাজে লাগে।

সত্যানুসরণ-এ শ্রীশ্রীঠাকুর বলছেন, একটা চাইতে গিয়ে দশটা চেয়ে ব'স না, একরেই যাতে চরম হয় তাই কর, সকলগুলিই পাবে। জীবনকে যে-ভাবে বলি দেবে, নিশ্চয় তেমনতর জীবন লাভ ক'রবে। যে-কেহ প্রেমের জন্য জীবন দান করে, সে প্রেমের জীবন লাভ করে। উদ্দেশ্যে অনুপ্রাণিত হও, আর প্রশান্তচিত্তে সমস্ত সহ্য কর, তবেই তোমার উদ্দেশ্য সফল হবে।

কথাগুলো একেকজনের কাছে একএকরকম লাগতে পারে। মূল আলোচনার আগে অন্যান্য অবতাররা কে কি বলেছিলেন এমন কিছু কথা সংগ্রহ করলাম।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, যে কেবল নিজের দুঃখকে আপন করে জীবন কাটায় সে শক্তিহীন হয়ে পড়েকিন্তু যে ব্যাক্তি সমগ্র সমাজের দুঃখ আপন করে জীবন কাটায় সে শক্তিশালী হয়ে ওঠে

বাইবেল এর, ইউহোন্না ৩ এর ১৫ ও ১৬ নং আয়াতে বলা হয়েছে,

. যে কেহ তাঁহাতে বিশ্বাস করে, সে অনন্ত জীবন পায়। কারণ ঈশ্বর জগৎকে এমন প্রেম করিলেন যে, আপনার একজাত পুত্রকে দান করিলেন, যেন, যে কেহ তাঁহাতে বিশ্বাস করে, সে বিনষ্ট না হয়, কিন্তু অনন্ত জীবন পায়।

মানুষের শক্তি রয়েছে নিজেকে দমন করার। তাই বুদ্ধ বলেছেন: ‘যো সহস্সং সহসসেন সঙ্গামে মানুষে জিনে/ একঞ্চ জেয়্যমত্তানং স বে সঙ্গামজুত্তমো।/’- যে ব্যক্তি যুদ্ধে হাজার হাজার মানুষকে জয় করে, তার তুলনায় যিনি কেবল নিজেকে জয় করেন, তিনিই সর্বোত্তম সংগ্রাম জয়ী।

পৃথিবীতে মানুষ জম্মগ্রহনের পরথেকেই চাওয়ার শুরু হয়, নতুন সন্তানের বাবা চায় ছেলে-মেয়ে ডাক্তার হোক তো মা চায় সে ইঞ্জিনিয়ার হোক। বাবা চায় সরকারী বিদ্যালয় ভর্তি করি তো মা চায় ভালো বেসরকারী বিদ্যালয়। আমৃত্যু মানুষের চাওয়ার শেষ হয় না।

তুমি যদি একজন ডাক্তার হতে চাও তাহলে তোমাকে অবস্যই MBBS পাশ করতে হবে আবার যদি ইঞ্জিনিয়ার হতো চাও তোমাকে BUET এ ভর্তি হতে হবে। তুমি যদি একজন দক্ষ চোর হতে চাও তোমাকে একজন ওস্তাদের কাছের তার প্রশিক্ষন নিতে হবে। জীবন তোমার তুমি কোন দিকে নিয়ে যাবে সেটা তোমারই একন্ত ব্যাক্তিগত। তুমি ডাক্তারই হও কিংবা ইঞ্জিনিয়ার তুমি যাই হও যদি সফল হতে পারো তাহলেই তোমার যেমন ভাল দেশের ও ভাল।

শ্রীশ্রীঠাকুর বলেছেন দশটা না চেয়ে যেকোন একটি চাইতে এবং সেটাই যেন চরম হয়। তাহলেই সব পাবে। এই সম্পর্কে শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের একটি ঘটনা মনে পরছে,

পিতা গত হয়েছেন নরেনের বেশ কিছুদিন। শত করেও অভাবকে দূরে সরিয়ে রাখা যাচ্ছে না। বাড়িতে মা-ভাই-বোনের কষ্ট মিটবে কীসে? ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে গিয়ে পড়লে নরেন। ‘আপনার মাকে একবারটি বলুন’।

অবাক হয়ে তাকান ঠাকুর, ‘কি বলব রে?’

নরেন ক্লিষ্টকণ্ঠে বলে ওঠে, ‘মা-ভাই-বোনের কষ্ট আর দেখতে পারি না। মায়ের কাছে বলুন আপনি যদি একটা চাকরি বাকরি হয় আমার...’

রামকৃষ্ণ শান্তভাবে চান নরেনের চোখে, ‘আমার মা, তোর কে?’

কালী মানে না নরেন। তার কাছে মা প্রস্তরপুত্তলিকা! মাথা হেঁট করে থাকে নরেন, ‘আমার কে তাতে কি আসে যায়? আপনার তো সব। বলুন না যাতে একটু টাকাকড়ির মুখ দেখি।’

ওরে ও সব বিষয়ের কথা আমি কইতে পারব না। ও আমার কাছে বিষ। তুই বল। একবার মা বলে ডাক’।

নরেন বলে, ‘আমার ডাক আসে না’। ‘তাই তো তোর এত কষ্ট। ওরে একবার তাঁর কাছে গিয়ে বল। মা তো মা জগজ্জননী। তিনি মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারেন? আজ মঙ্গলবার। রাত্তিরে কালীঘরে গিয়ে প্রণাম করে মার কাছে যা চাইবি তিনি তাই দেবেন’।

সত্যি?’

দ্যাখ না, সত্যি কি না!’

নরেন কালীঘরে প্রবেশ করল। রাত্রি একপ্রহর কেটে গেছে। মন্দিরে কেউ নেই। শুধু নরেন আর মা ভবতারিণী। মা আনন্দময়ীর ত্রিলোকমোহিনী মূর্তি। এখানে কোথাও কোন দুঃখ নেই, শোক নেই, অভাব-অভিযোগ নেই। কেবল এক অপার শান্তি বিরাজমান। এই মায়ের সামনে কি চাইবে নরেন? সে প্রণাম করে বলে উঠল, ‘মা, জ্ঞান দাও, ভক্তি দাও, বিবেক দাও, বৈরাগ্য দাও’।

ফিরে এল নরেন ঠাকুরের কাছে। ‘কি রে কি চাইলি? টাকাকড়ি চাইলি?’

নাঃ, সব ভুল হয়ে গেল, চাইতে পারলাম না।’

ঠাকুর বললেন, ‘যা যা আবার যা। প্রার্থনা করে বল মা আমায় চাকরি দাও, টাকাকড়ি দাও...’

নরেন আবার এসে দাঁড়াল মায়ের সম্মুখে। কিন্তু আবার এ কি হল তার? কি চাইলে সে মায়ের কাছে? তুচ্ছ টাকাকড়ি? না না, তা সে কেমন করে চায়? ‘মা আমাকে জ্ঞান, ভক্তি, বিবেক, বৈরাগ্য দাও’।

ফিরে এল নরেন ঠাকুরের কাছে।

কি রে চাইলি?’

নাঃ এবারেও পারলুম না। মাকে দেখামাত্র কেমন আবেশ হয়, কিছুই মনে করতে পারি না’।

দূর বোকা, আর একবার যা। মনকে বশে রেখে মায়ের কাছে যা চাইবার চেয়ে নে’।

নরেনকে মন্দিরের ভেতরে ঠেলে পাঠালেন ঠাকুর।

নরেন দেখলে শুদ্ধা চৈতন্যময়ী মা রয়েছেন চরাচর ব্যাপ্ত করে। সেখানে নিরানন্দের কোনও স্থান নেই। সবেতেই আনন্দের প্রকাশ। হীনবুদ্ধির মতো সে চৈতন্যময়ীর কাছে টাকাপয়সা চাইব? ‘মাগো, আর কিছু চাই না, কেবল জ্ঞান, ভক্তি, বিবেক, বৈরাগ্য দাও’। বারে বারে প্রণাম করতে লাগল নরেন।

কি রে কি চাইলি’? জিজ্ঞেস করলেন ঠাকুর।

চাইতে লজ্জা করল।’

ঠাকুর হাসলেন। আনন্দে হাত বুলিয়ে দিলেন নরেনের মাথায়। ‘মা বলে দিয়েছেন মোটা ভাত কাপড়ের অভাব তোদের কোনওদিন হবে না’।

পরবর্তী জীবন কি হয়েছিলেন সেই বিষয় আমরা সবাই জানি।

জীবনকে যে-ভাবে বলি দেবে, এখানে বলি মানে কি কিছু হত্যা করে ভগবান বা ঈশ্বরকে উৎসর্গ করা কে বুছিয়েছেন ঠাকুর? বলি শব্দের অর্থ বাংলা অভিদান থেকে পাই

* যজ্ঞাদিতে নিবেদ্য বস্তু।

* যজ্ঞাদি উপলক্ষ্যে প্রাণীহত্যা বা হন্তব্য প্রাণী (বলির পাঁঠা)

* উত্সর্গ, বিসর্জন (নিজের স্বার্থ বলি দেওয়া)

* উপহার।

* জীবগণকে খাদ্যদান বা প্রদত্ত খাদ্য (গৃহবলিভুক)

* ভূতবলিরূপ যজ্ঞ।

* রাজস্ব।

* বামন অবতারে বিষ্ণুর দ্বারা পরাজিত দৈত্যরাজ। [সং. √ বল্ + ]

ইত্যাদি।

শ্রীশ্রীঠাকুর প্রভু রামচন্দ্র এর ভক্ত হনুমান কে শ্রেষ্ঠ ভক্ত বলেছেন, হনুমান প্রথমে প্রভু রামচন্দ্রের কাছে এসেছিলেন যদি মন্ত্রী হওয়া যায় সেই আশায়। কিন্তু প্রভুকে এতটাই ভালবাসলেন যে তার সব চাওয়া একতে মিলে গেল মানে প্রভুকে কিভাবে খুসি রাখা যায়।

হনুমানের লংকা যাত্রাটি যদি একটু সংক্ষেপে বর্ননা করা যায়, তাহলে দেখা যায়। তিনি প্রভুর জন্য কি না করতে পারেন। জাম্মুবান যখন হনুমানকে আদেশ করলেন তুমিই একমাত্র যেকিনা লংকা যেতে পার। হনুমান বললেন আপনারা যদি আদেশ করেন করেন আর প্রভুর ইচ্ছা যদি হয় তাহলে পারবো।

হনুমান ভারতের মহেন্দ্র নামক পর্বতের চূড়া থেকে থেকে আকাশপথে অগ্রসর হওয়ার জন্য লাফ দিলেন। কিছুদুর যাওয়ার পর তার পথ আগলে দাড়াল “মৈনাক” পর্বত। যিনি দেবী পার্বতী ও দেবী গঙ্গার ভ্রাতা এবং দেবরাজ ইদ্রের কারনে সমূদ্রে আত্মগোপন করে ছিলেন। মৈনাক পর্বত কিছুটা সময় বিশ্রাম করতে বলেন হনুমানকে। কিন্তু তিনি বিনয়ের সাথে বলে এখন সময় নেই পরে একসময় তার কথা রাখবেন। কারন প্রভুর কাজ শেষ না করা পর্যন্ত তিনি বিশ্রাম নিতে নারাজ।

সেখান থেকে বিদয় নিয়ে আবার তিনি লাফ দিলেন। স্বর্গের সমস্ত দেবতা হনুমানজীর প্রজ্ঞা, জ্ঞান এবং শক্তি পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন, কিছুদূর যাবর পর আবার বাধা হয়ে দাড়ালেন তারা সর্প মাতা সুরসা”কে প্রেরণ করেছিলেন। সুরসা দৈত্যাকার রাক্ষসীর রুপ ধারন করে হনুমানের পথ আটকে দেন এবং বলেন এই পথ দিয়ে যেতে গেলে তার মুখের ভেতর থেকে বেরিয়ে তবেই যাওয়া যাবে। এই কথা শুনে হনুমান নিজের শরীরের আকৃতি বিশালাকার করে তোলেন। হনুমানের বিশালাকৃতি দেখে সুরসাও নিজের মুখের আকৃতি বিশালাকার করে তোলে। এইবার হনুমান হঠাৎ করে নিজেকে তার ক্ষুদ্র রুপ ধারণ করেন এবং তাঁর মুখের মধ্যে প্রবেশ করেন এবং নাক থেকে বেরিয়ে আসেন।

সেখান থেকে বিদয় নিয়ে আবার তিনি লাফ দিলেন। আকাশ ও সাগরের দুটি বাধার সম্মুখীন হওয়ার পরে হনুমান তাঁর তৃতীয় বাধা দানবী “সিংহিকা” নামক এক দানবীর বাধায় পড়েছিলেন। এই সিংহিকা দানবী তার ক্ষমতা বলে হনুমানজীর ছায়া ধরে তাকে গিলে ফেলেছিল। হনুমানজী দানবীর শরীরের ভেতরে গিয়ে তার ভেতরের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ নষ্ট করে তাকে হত্যা করে। এইভাবে হনুমানজী তার তৃতীয় বাধাও বীরত্বের সঙ্গে দূর করেন।

সেখান থেকে বিদয় নিয়ে আবার তিনি লাফ দিলেন। এরপর লঙ্কায় পৌছে দেখেন প্রবেশ দ্বারে সমুদ্র তটে হনুমানকে বাধা দেন লঙ্কার পাহারাদার “লঙ্কিনী”। হনুমানজী রাতে সবার অলক্ষে লঙ্কায় প্রবেশ করার পরিকল্পনা করলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী হনুমানজী রাতে যখন লঙ্কায় প্রবেশ করতে যাবেন তখনই তিনি লঙ্কার অতন্দ্র প্রহরী রাক্ষসী লঙ্কিনীর সম্মুখীন হন। তিনি হনুমানকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন কিন্তু যখন তিনি বুঝতে পারেন যে তিনি একজন অনুপ্রবেশকারী তখন তিনি তাকে আক্রমণ করেন এবং সেই লড়াইয়ে লঙ্কিনী পরাস্ত হন।

লঙ্কিনী ছিলেন ব্রহ্মার বাসস্থানের একজন প্রহরী। ব্রহ্মার অভিশাপে তাকে রাক্ষস কুলের বাসভবনের প্রহরী হতে হয়েছিল। ব্রহ্মা তাকে বলেছিলেন যে, সে তখনই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবেন যখন কোনও বানর তাকে যুদ্ধে পরাজিত করবে এবং এভাবেই তার অভিশাপের অবসান ঘটবে।কিছুক্ষণ পরে তিনি বুঝতে পারলেন যে এই বানরটি কোনও সাধারণ বানর নয়। তিনি ব্রহ্মার অনুগ্রহের কথা স্মরণ করেন। তত্ক্ষণাত লঙ্কিনী হনুমানের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন এবং তিনি বুঝতে পারেন যে ব্রহ্মার ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হতে চলেছে।

প্রভুর প্রতি যদি ভালবাসা গভীর না হতো তাহলে হয়তো হনুমান কখনোই লঙ্কায় গিয়ে মাতা সীতা দেবীর খবর আনতে পারতেন না। এই হচ্ছে প্রভুর প্রতি ভালবাসা।

আজ সারা বিশ্বের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা স্বামী বিবেকানন্দ ও ভক্ত হনুমানকে পূজার আসনে বসিয়ে পূজা দেয়। এই হচ্ছে প্রাপ্তি। তাদের উভয়ের একটাই চাওয়া ছিল কিভাবে তাদের প্রভু যুগপুরুষোত্তমকে খুশি করা যায়। এবং নিত্য নতুন ভাবে তাদের প্রচার করা।


No comments:

Post a Comment